prof-kamal

This page is for our beloved Late Professor M Kamal





 

 

অধ্যাপক মোহাম্মদ কামালের জীবনস্মৃতি

আয়শা ফারুকা এবং মরহুম ডা: গোলাম মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের জ্যেষ্ঠপুত্র মোহাম্মদ কামাল ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ফকির লালন সাঁইয়ের পদধূলিধন্য কুষ্টিয়ায়।

ছোটবেলায় তিনি প্রকৌশলী, মেকানিক থেকে শুরু করে ভবঘুরে – অনেক কিছুই হতে চাইতেন। ভালো লাগতো গান, শিল্প, সাহিত্য, মানবিকবিদ্যা, বিজ্ঞান  – সবকিছুই। তবে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তে তাঁর একটু বেশিই ভালো লাগতো। বই পড়ার নেশা তাঁর এতটাই বেশি ছিল যে বই হাতে পেলে দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যেতেন। সবসময় যে সেটা পাঠ্যবই হতো, তা নয়। এই নেশাই তাঁকে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

রেলওয়ের চিকিৎসক হিসেবে তাঁর পিতার বদলির চাকরি এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে তাঁকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করতে হয়েছে বহুবার। লাহোরের ডন বসকো স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করে ক্রমানুসারে ঈশ্বরদী স্কুল, পার্বতীপুর জ্ঞানাংকুর হাইস্কুল, চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি গভর্মেন্ট হাইস্কুল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ কামাল তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো পর্যায়ে ছোট-বড় কোনো পরীক্ষায় কখনো অকৃতকার্য হননি। উপরন্তু তিনি ক্লাস ওয়ান থেকে সরাসরি ক্লাস থ্রি তে ভর্তি হয়েছিলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ড থেকে অষ্টম স্থান অর্জন করেছিলেন তিনি।

১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে তিনি একবছর একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে দেড় মাস কাজ করার পর তাঁর বদলি হয় তৎকালীন আইপিজিএমআর-এ, প্যাথলজির প্রভাষক হিসেবে। এখানে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই তিনি ১৯৮২ সালে আইপিজিএমআর-এর এমফিল প্যাথলজি কোর্সে ভর্তি হন। তাঁর কোর্স শেষ হয় ১৯৮৪ সালে। তারপর ১৯৮৬ সালে প্যাথলজির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং তাঁকে বদলি করা হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। তিনি ১৯৮৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফেলোশিপ অর্জন করে বিলাতে পাড়ি জমান। যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর মেয়াদী ইমিউনোলজি কোর্সে ভর্তি হন তিনি। সেটি সফলভাবে সম্পন্ন করার পর একই বিভাগে পিএইচডি সম্পন্ন করেন মাত্র দুই বছর তিন মাস সময়ের মধ্যে।

দেশে ফিরে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন আইপিজিএমআর-এ প্যাথলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তিনি পুনরায় যোগদান করেন। তারপর ক্রমে সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক হিসেবে তিনি পদোন্নতি পান। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়াস এন্ড সার্জনস ২০০৮ সালে মোহাম্মদ কামালকে হিস্টোপ্যাথলজিতে সম্মানসূচক এফসিপিএস ডিগ্রি প্রদান করে।

মোহাম্মদ কামাল বাংলাদেশ মেডিকেল  বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এবং প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সহ বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। অবসর গ্রহণের সময় তিনি বেসিক সায়েন্স ও প্যারাক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের ডিন হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অবসর গ্রহণের পরে তিনি প্যাথলজি বিভাগে পুনরায় যোগ দেন ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে।

তাঁর মোট ১২০ টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের নানা নামকরা বৈজ্ঞানিক জার্নালে। তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেছেন প্যাথলজিসহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অন্যান্য অন্তত ৪০ জন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। ইমিউনোফ্লুরেসেন্স মাইক্রোস্কোপি এবং ডিজিটাল প্যাথলজি সহ বেশ কিছু বিভাগীয় আধুনিকায়নের সূচনা হয়েছিল তাঁর হাতে।

বাংলাদেশে প্যাথলজিস্টদের অগ্রণী সংগঠন বাংলাদেশ একাডেমি অব প্যাথলজিস্ট (বিএপি) এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ কামাল আমৃত্যু প্যাথলজি ও সর্বোপরি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। তিনি যে শুধু একজন একাডেমিশিয়ান, প্যাথলজিস্ট ও সংগঠক ছিলেন তা নয়, শিক্ষার্থীদের মাঝে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ভালো শিক্ষক ও সর্বোপরি ভালো মানুষ হওয়ার বার্তা। তিনি যেন শুধু শিক্ষক ছিলেন না, শিক্ষার্থীদের অভিভাবকও ছিলেন। বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গেও ছিল তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক।

মোহাম্মদ কামালের ছোট দুই বোনের একজন ঢাকায় এবং আরেকজন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। তাঁর স্ত্রী সাদিয়া জিনাত একটি বেসরকারী কলেজে ইংরেজির শিক্ষিকা। তাঁদের তিন সন্তান। তিনজনই ছেলে। জ্যেষ্ঠপুত্র বদরুদ্দীন কামাল ক্যানবেরায় অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পন্ন করেছেন। মেঝছেলে মহিউদ্দীন কামাল সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে প্যাথলজি বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণরত আছেন। কনিষ্ঠপুত্র রফিকউদ্দীন কামাল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।

মোহাম্মদ কামালের অনেকগুলো শখ ছিল। একসময় ছিল তাঁর খুব ডাকটিকেট জমানোর শখ। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নামে প্রকাশিত ডাকটিকেটের মতো দুষ্প্রাপ্য ডাকটিকেট তাঁর সংগ্রহে ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে সেই বহুমূল্য সংগ্রহ চিরতরে হারিয়ে যায়।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফটোগ্রাফিতে মোহাম্মদ কামালের হাতেখড়ি। পিতার কাছ থেকে ফটোগ্রাফির ঝোঁক তিনি পেয়েছেন। তাঁর পিতার ক্যামেরায় তোলা ছবির মধ্যে যেমন আছে কবিগুরুর ভাষণ দেওয়ার মুহূর্ত, তেমনি আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছা্ত্রদের নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মোহাম্মদ কামাল সময় সুযোগ পেলে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়েন। অবশ্য তাঁর ফটোগ্রাফির একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল কৌতুহলোদ্দীপক কেসের ফটোমাইক্রোগ্রাফ। ছবি তোলার পাশাপাশি ছবি আঁকাতেও ছিল তাঁর আগ্রহ ও দক্ষতা। তৈলচিত্রের অল্পকিছু কাজ করলেও তাঁর বেশিরভাগ কাজ পেনসিল স্কেচ ও জলরঙের।

বইপড়ায় মোহাম্মদ কামালের আগ্রহের ব্যাপারে শুরুতেই বলা হয়েছে। মাত্রাটি বোধকরি স্যার আশুতোষ মুখার্জীর সাথে তুলনীয়! সব ধরণের বই পড়ার অভ্যাস থাকলেও ইতিহাস এবং জীবনমুখী উপন্যাসে তাঁর আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। বাংলা সাহিত্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ মুজতবা আলী এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইংরেজি সাহিত্যের মধ্যে জ্যাক লন্ডনের লেখা পড়তে তিনি বেশি পছন্দ করতেন।

চলচ্চিত্র ছিল তাঁর আরেকটি শখ। তিনি ছিলেন পুরোনো বাংলা সিনেমার ভক্ত। সাদাকালো হলে সবচেয়ে ভালো। প্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে পথের পাঁচালি এবং সুবর্ণরেখার নাম আলাদা করে বলা যায়। রঙিন বাংলা সিনেমার মধ্যে শুধু সেগুলোই দেখতেন যেগুলোতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন। বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের মধ্যে All Quiet on the Western Front এবং The White Tiger তাঁর মনে দাগ কেটেছিল।

সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ ছিলেন মোহাম্মদ কামাল। পশ্চিমা জ্যাজ থেকে শুরু করে উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী – সবই সমান আগ্রহ নিয়ে শুনতেন তিনি। তবে পশ্চিমা সঙ্গীতের মধ্যে হার্ড রক তাঁর খুব একটা প্রিয় ছিল না। অপেরা শিল্পীদের মধ্যে কারমেন হাবেনেরার কণ্ঠ তাঁর খুব ভালো লাগতো। আর আধুনিক বাংলা গানের জগতে মান্না দে এবং শ্যামল মিত্র ছিলেন তাঁর প্রিয়। গান যদি শোনার মতো হয় তাহলে যেকোনো শিল্পীর গানই তিনি শুনতেন এবং আনন্দ পেতেন।

এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছিলেন তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে। বাংলা ভাষাভাষী ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে প্রিয় ব্যক্তিত্ব আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী এবং নেলসন ম্যান্ডেলা। এই তালিকা সম্পূর্ণ নয়। প্রেক্ষাপটের সাপেক্ষে প্রিয় ব্যক্তিত্বের তালিকায় যুক্ত হতে পারেন এমন মনীষী আছেন অনেকেই। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা বললে অবধারিতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আসে। মানবতার বৃহত্তর মুক্তির সংগ্রামের কথা বললে আসে যীশু, মুহম্মদ, গৌতম বুদ্ধের নাম। তাই মোহাম্মদ কামালের অন্যতম প্রিয় উক্তি ছিল, “if you want to drive yourself use your brain but if you want to drive others use your heart.”

খাবারদাবারে মোহাম্মদ কামালের আগ্রহের ব্যাপারে সিঙাড়া-বিরিয়ানি সহ বিভিন্ন ধরণের জনশ্রুতি থাকলেও নিজের ভাষ্যমতে প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রিয় খাবার ছিল সদ্য রান্না করা ধোঁয়া ওঠা ভাত এবং সুন্দর করে প্রস্তুত করা ডাল। একটু আধটু সাধারণ সবজি ও রুটিও চলতে পারে। শর্ত ছিল দুটো – সদ্য চুলা থেকে নামানো হতে হবে এবং রান্নাটা হতে হবে উন্নতমানের। মাছ-মাংস না হলেও চলবে। অসুস্থ হওয়ার পর তিনি লইট্যা মাছ খেতে চেয়েছিলেন এবং তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যা তিনি তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন।

অবসরে গিয়ে কী কী করবেন তার একটি বিশাল তালিকা করেছিলেন মোহাম্মদ কামাল। কীর্তিময় শিক্ষকজীবনে তাঁর কাছে ফটোমাইক্রোগ্রাফ সহ শিক্ষা উপকরণের যে বৃহৎ ভাণ্ডার সঞ্চিত হয়েছে তা বই, গবেষণা নিবন্ধ ইত্যাদি লিখে, ক্লাস নিয়ে এবং অন্যান্য উপায়ে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তথা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইতেন। স্যাক্সোফোনটা ভালো করে বাজানো শিখতে চেয়েছিলেন যাতে যখন তখন যেকোনো সুর সেটায় তুলতে পারেন। অবসরের একটা বড় সময় কাটাতে চাইতেন তাঁর সংগৃহীত বইগুলো পড়ে।

অবসরে যাওয়ার পরও আসলে তাঁর অখণ্ড অবসর ছিল না। আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগ তাঁকে বরণ করে নেয় ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে। তার মধ্যেও বেশ কিছু দেশও তিনি ভ্রমণ করেন। অনেক শখ পূরণ করেন। কিছু অপূর্ণ থেকে যায়। সেই সাথে তাঁর একাডেমিক কার্যক্রম সদর্পে চালু ছিল বিগত কয়েক মাসের অসুস্থতার আগ পর্যন্তও। প্যাথলজির জন্য, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে হোক কিংবা দি ল্যাবরেটরিতে, সময় দিতে তাঁর কখনো খারাপ লাগতো না। একটা জটিল কেস নিয়ে ভাবতে ভাবতে মগ্ন হয়ে যেতেন যেন তিনি গোয়েন্দা শার্লক হোমস সেজে এক দুরূহ রহস্যভেদের অ্যাডভেঞ্চারে নেমেছেন। পৃথিবীর বুকে তাঁর অভিযানের ইতি ঘটে ৯ মে ভোরে, চিকিৎসারত অবস্থায়।

তাঁর আরও একটা ইচ্ছা ছিল, এই জীবনের পরের জীবনে কী আছে সেটা জানা। তবে একবার জানা হয়ে গেলে সেই জ্ঞানটুকু আর কাউকে বিতরণ করতে পারবেন না, এটা ছিল তাঁর আফসোস। তিনি অবশ্য আশা করতেন, এই জীবনের পরের জীবনটা ভালোই হবে।

তথ্যসূত্রঃ অবসরে যাবার পর রেকর্ডকৃত সারের সাক্ষাতকার, পরিবারের সদস্যদের সাথে কথোপকথন, অধাপক অসীম বড়ুয়া ও অধ্যাপক জিল্লুর রহমান প্রমুখের স্মৃতিচারণ থেকে সংগ্রহ করে গ্রন্থনা করেছেন ডাঃ সৌমিত্র চক্রবর্তী ।

See Slideshow Video of Kamal Sir in YouTube

 
































Meeting on Memory of Dr. Kamal









Videos:
Video 1:

Video 2:

Video 3:

Video 4: